হ্যাকিং হওয়া বিডি২৪লাইভ ডট কমের কোন তথ্য পূন:উদ্ধার করা যায়নি; হ্যাকার চিহ্নিত

hack
বিশেষ প্রতিনিধি: বিকাল ৪টা! বিডি২৪লাইভ ডট কমের আইটি অফিসার আশরাফ ভাই একটি বিষয় সম্পাদককে দেখানোর জন্য ওয়েব সাইটটি অপেন করতে বললেন। সম্পাদক ওয়েবটি খোলার সাথে সাথে হাঁ করে তাকিয়ে থাকলেন মনিটরের দিকে। HACKED BY Shunn0 & Flame । হ্যাক!  আশরাফ ভাইয়ের কথা শোন মাত্র চমকে উঠলেন সম্পাদক। বুঝতে বাকি থাকলনা আমাদের প্রিয় সাইটটি হ্যাক করা হয়েছে।বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টার দিকে দেশের অন্যতম জাতীয় অনলাইন নিউজ প্রোটাল বিডি২৪লাইভ ডট কম সাইটটি এক দল অনলাইন ক্রাইম অপারেটর দ্বারা আক্রান্ত হয়। হ্যাকাররা ওয়েব সাইটটির সকল তথ্য মুছে দেয়। অনেক চেষ্টা করার পরেও আইটি বিভাগ তথ্য পুনউদ্ধার করতে পারেনি। বিডি২৪লাইভ ডট কমের পরিচালক জাহিদ আহমেদ পরিস্কার ভাবে জানিয়ে দিয়েছেন, ’যে ভাবে হোক হ্যাকারকে চিহ্নিত করতে হবে এবং আইনের মাধ্যমে তাকে শাস্তির ব্যাবস্থা করতে হবে।’ সবারই একই কথা তথ্য যেহেতু নষ্ট করে দিয়েছে সেহেতু তাকে পাকরাও করতেই হবে।
হ্যাকারদের শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা নিতে পল্লবী থানায় বিডি২৪লাইভ এর ডট কমের পক্ষ থেকে সহ-সম্পাদক আবু তালেব বিবাদী হয়ে অভিযুক্ত তিন জনের বিরুদ্ধে একটি সাধারন ডায়রী করেন। পল্লবী থানার জিডি নম্বর ১৬৬৬।  সাধারন ডায়েরীতে উল্লেখ করা হয় অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করার জন্য এবং আইনের আওতায় এনে শাস্তিমূলক ব্যাবস্থা গ্রহন করার জন্য। আইনজীবিদের পরামর্শ অনুযায়ী জিডি এর পরবর্তী ধাপ এ আগানো হবে বলে জানিয়েছেন পরিচালক। এ ব্যাপারে পল্লবী থানার এস.আই আব্দুল আজিজের উপর তদন্ত ভার ন্যাস্ত করা হয়। তিনি অভিযুক্তদের ব্যাপারে যত দ্রুত সম্ভব ব্যাবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
বর্তমান সময়ে হ্যাকিং একটি মারাত্বক আকার ধারন করেছে। এর পূর্বে বাংলাদেশের আরো গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সাইট হ্যাক করেছে হ্যাকাররা। এবং আশ্চর্য্য বিষয় হল হ্যাকার বেশিরভাগই আমাদের দেশের সন্তান এবং বয়সে তরুন। শুধু হ্যাক করেই তাদের শান্তি হয় না। তারা ওয়েব সার্ভারে থাকা সকল তথ্য মুছে দেয়।
যাই হোক এর পর শুরু হল আমাদের হ্যাকার সন্ধান এর প্রকিয়া। হ্যাকার সন্ধানের জন্য প্রয়োজন তথ্য এবং তথ্যের সূত্র ধরেই আমরা এগুতে থাকি।
যেভাবে হ্যাকার চিহ্নিত হল:
একুশে নিউজের ওয়েব সাইট
বিডি২৪লাইভ ডট কম হ্যাকিং হওয়ার পর হ্যাকারদের দেয়া একটি পেইজটি প্রদর্শিত হয়। এখানে তারা তাদের HACKED BY Shunn0 & Flame হিসেবে নিজেদের আক্ষায়িত করে এবং সিকিউরিটির সাহায্যের জন্য একটি ওয়েব সাইট এর কথা লিখে রাখে সেটা হল www.cybercrime.com.bd । তাদের এই ওয়েব সাইটের সূত্র ধরে তদন্ত টিম কাজ করতে থাকে। তাদের ওয়েব সাইটে এ ডুকে দেখা যায় পুরো একটি হ্যাকিং টিউটেরিয়াল ওয়েব সাইট। এই সাইটটিতে হ্যাকিং এর কলাকৌশল বিস্তারিত লেখা রয়েছে। তারা তাদের ওয়েব সাইটে দাবি করে তারা www.cybercrime.com.bd অর্থাৎ তারা একটি নৈতিক হ্যাকার কমিটি। এই ওয়েব সাইটে এ দেখা যায় একটি ফোরাম তৈরি করা। সেখানেও হ্যাকিং বিষয়ে আলোচনা। হ্যাকিংকে একটি নেশা হিসেবে পরিণত করার লক্ষ্যে তারা তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
তাদের এই সাইটটির অবস্থান জানাতে গেলে দেখা যায় সাইটি একটি ব্যাকলিংক রয়েছে http://www.ekusheynews.com/ এ । ওয়েব সাইটটিতে লেখা ছিল  “ওয়েব সাইটটি পূর্ণনির্মানাধিন আছে। অনুগ্রহ পূর্বক পরবর্তিতে ভিজিট করুন।” এবং সর্বশেষে লেখা “Site Develop By: CYBERCRIME.COM.BD” ।  আর এই ওয়েব সাইটটি LocalHost.com.bd এ থেকে রেজিষ্ট্রেশন করা হয়। সুতরাং বিষয়টি পরিস্কার যে যেহেতু LocalHost.com.bd থেকে সাইটটি রেজিষ্ট্রেশন করা সেহেতু সাইবার ক্রাইম একজনেরই। এবং বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য আমরা বিটিসিএলের সাহায্য নেই। যেহেতু ওয়েবটি .com.bd নেয়া। ওয়েব সাইটিতে প্রবেশ করলে দেখা যাবে ব্যাক্তির মোবাইল নাম্বার এবং একটি ইমেইল এড্রেস। কোন যোগাযোগরে ঠিকানা এখানে নেই। ইমেইল এড্রেস এবং মোবাইল নাম্বারের সূত্র ধরে আমরা খুজে পাই সাইবার ক্রাইমের হোতা জুয়েল আহমেদ। বিষয়টি নিশ্চিত হবার জন্য আমাদের টিম ওয়েবের রেজিষ্ট্রেশন করাবে বলে কৌশলে তার পরিচয় নিশ্চিত হয়। পরবর্তিতে জুয়েল আহমেদ নিজেই বিডি২৪লাইভ ডট কমের কার্যালয়ে ফোন করে স্বিকার করে নেয় যে সে ক্রাইম ডট কম ডট বিডি এর মালিক।
কে এই জুয়েল আহমেদ?
জুয়েল আহমেদ
জুয়েল আহমেদ ঢাকার কলাবাগানে অবস্থিত বি.এস.আই ইঞ্জিনিয়ারিং ইনিস্টিটিউড এ লেখা পড়া শেষ করে। তার মূল কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ওয়েব সাইট এর ডিজাইন হ্যাকিং করা। গ্রাহকদের চাহিদা মত সাইটটের ডিজাইন হ্যাক করেন তিনি। তার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষিরার জাউডাঙ্গা গ্রামে। জুয়েলে নামে এর আগেও অনেক রকমের অভিযোগ রয়েছে। অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ হ্যাকিং এর সাথে জড়িত তিনি। ব্যাক্তিগত ভাবে তিনি ডোমেইন এবং হোস্টিং এর ব্যাবসা করেন। LocalHost.com.bd ওয়েব সাইটটি তারই মালিকাধিন।
কেন বিডি২৪লাইভ হ্যাকিং করল তারা?
আরিফুল ইসলাম শাওন
পিছনে ফিরে দেখা যাক। ১৫ই অক্টোবার ২০১১ তারিখে বিডি২৪লাইভ এর মেইল বক্সে ফাহাদ টিটু নামে একজন মেইল পাঠান তার লেখা ছাপানোর জন্য। লেখার বিষয় বস্তু ছিল “Dolancer ও এর প্রতারনা গল্প।” লেখাটি বিডি২৪লাইভ ডট কমের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক লেখা হিসেবে প্রকাশিত হয়। ইমেইলে পাঠকের লেখাকে আমরা গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করি।
ডুলান্সার বিষয়ক লেখাটি প্রকাশের পর প্রচুর সাড়া পাই আমরা। কিছুদিন পর রংপুর থেকে আরিফুল ইসলাম শাওন নামের একজন বিডি২৪লাইভ ডট কম এর মেইলে একটি মেইল করে এবং মোবাইলে সরাসরি ফোন করে সে দাবি করে লেখাটি তার এবং সে লেখাটির যে তার তার জন্য কতগুলো লিংক দেয়। স্বভাবতই আমরা তার লিংক যাচাই করে তার নামটি লেখকের স্থলে দিয়ে দেই। নাম পরিবর্তনের কয়েক মিনিট পরেই নাজমুল আহসানে নামের একজন ০১৭১৭০১৭৩৮৫ নাম্বার থেকে ফোন করে একই লেখা নিজের বলে দাবি করে এবং লেখাটি মুছে ফেলার জন্য হুমকি প্রদান করে। বিডি২৪লাইভ ডট কম থেকে তাকে বলা হয় নিয়ম অনুযায়ী একটি মেইল করতে। তিনি মেইল করতে পারবেন না এবং বিডি২৪লাইভ ডট কমকে দেখে নেবার হুমকি প্রদান করে। তার এই হুমকির সত্যতা পাওয়া যায় তার ফেইসবুকের আলাপচারিতায়। তার সাথে কথোপকথোনের অডিও রেকর্ড বিডি২৪লাইভের কার্যালয়ে রয়েছে। এর পর থেকেই নাজমুল আহসানের চোখ বিডি২৪লাইভ ডট কমের দিকে।
কে এই নাজমুল আহসান?
নাজমুল আহসান
নাজমুল আহসান। ডাক নাম মুক্ত বলে জানে সবাই। পেসায় আইটি ইঞ্জিনিয়ার। সর্বদা ব্যাস্ত থাকে ইন্টারনেট আর নিজের ব্যাবসা প্রতিষ্ঠান মেধাবী ডট কম নিয়ে। তারই পরিচালিত ওয়েবগুলো হল http://medhabi.com, http://www.muktokontho.com/, http://www.muktoblog.net । তিনি একজন ব্লগার। দেশের সব ব্লগ সাইটেই তিনি নিয়মিত লেখালিখি করেন।
নাজমুল আহসান একজন হ্যাকার নামেও পরিচিত। যারা হ্যাকিং সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে ব্যাস্ত আছে তারা তাকে ভাল করেই চিনেন এবং জানেন। ইতিমধ্যে তিনি বেস কয়েকটি সাইটের পার্সওয়ার্ড চুরি করেছেন। সর্বশেষ তিনি একটি বেসরকারি ইউনিভার্সিটির ওয়েব সাইট হ্যাক করেছে। এবার তার কবলে পড়ল বিডি২৪লাইভ ডট কম। সে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি থেকে সিএসই পড়াশোনা করেছে। গ্রামের বাড়ি বগুড়ার মহিমাগঞ্জে। সেখানে তিনি ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল ও কলেজে লেখা পড়া করেছেন। বিডি২৪লাইভ ডট কম  হ্যাকিং করার পরিকল্পনা অনেক আগে থেকেই করেছিলেন নাজমুল। তার হ্যাকিং এর পরিকল্পনা তার ফেইসবুকের মাধ্যমে তুলেও ধরেছিলেন। বিডি২৪লাইভ ডট কমকে তিনি যে হুমকি দিয়েছেন তাও তিনি নিজেই ফেইসবুকে বন্ধুদের সাথে গর্ভের সাথে শেয়ার করেছেন।
হ্যাকিং এর কার লাভ হল?
নাজমুল আহসান বা জুয়েল আহমেদ হয়ত হ্যাকিং করে নিজেদের আত্ব তৃপ্তি ঘটিয়েছেন। কিন্তু তারা জানেন না কত বড় ক্ষতি করেছেন। তারা একটি অনেক তথ্য সমৃদ্ধ সাইটের তথ্য নষ্ট করে দিয়েছেন যা কোনদিনও পুনউদ্ধার করা সম্ভব নয়। হ্যাকিং এর মত জঘন্য অপরাধের জন্য আমাদের দেশের আইন অতি ঠুন্ক।
বিডি২৪লাইভ ডট কম হ্যাক হওয়ার পর দেশ বিদেশ থেকে অনেক ফোন আসতে থাকে। এমনকি বাংলাদেশে যারা ভুক্তভোগী রয়েছে তারাও এর বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নেওয়ার অনুরোধ করেন।
undefinedনাজমুল আহসান এবং শাওনের মধ্যে ফেইসবুকের আলাপচারিতা
বর্তমান সময়ে সাইবার পরিসরের অবাধ স্বাধীনতার সুযোগে ব্লগের অপব্যবহার এবং সাইবার অপরাধের পরিমাণও লক্ষণীয় হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই অপরাধসমূহকে আমরা তিনটি পর্যায়ে দেখাতে পারি
১। অর্থনৈতিক: সংস্থা/ব্যক্তির অর্থনৈতিক তথ্য/অর্থ চুরি;
২। প্রযুক্তিগত: কোড, কপিরাইট ছিনতাই, হ্যাকিং ও প্রযুক্তিগত ভৌত ও অভৌত স্থাপনার ক্ষতিসাধন; এবং
৩। সামাজিক: হুমকি, যৌন নির্যাতন ও অবমাননা। সামাজিক অপরাধসমূহ সাধারণ ব্যবহারকারীদের সঙ্গে অহরহ সংঘটিত হচ্ছে। ওয়েবে মৃত্যুর হুমকি; যৌন হয়রানি এবং ছবি ও পরিচয় পর্নোগ্রাফিতে ব্যবহার, প্রোফাইল ও কপিরাইট হ্যাকিং, ব্লগারদের মানবীয় অনুভূতির সঙ্গে আর্থিক প্রতারণা, ই-মেইল অ্যাড্রেস স্প্যামারকে প্রদান, পাইরেসি, সংবিধানের অবমাননা, সাম্প্রদায়িক নিগ্রহ ইত্যাদি সংগঠিত হলে বাস্তব জীবনের মতোই মানুষ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।
এসব অপরাধ দমনের জন্য আইন প্রণেতাদের এ ক্ষেত্রে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একযোগে গবেষণা পরিচালনা করে প্রতিরোধব্যবস্থা তৈরি করতে হবে। না হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করে জাতীয় উন্নয়নের পরিবর্তে বাধাগ্রস্ত করবে তথ্যপ্রযুক্তি প্রসার তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার বাস্তবতা।
ইংল্যান্ড বিশ্বে প্রথম সাইবার আইন প্রণেতা হিসেবে তৈরি করে ‘কম্পিউটার মিসইউজ অ্যাক্ট ১৯৯০’। ই-ক্রাইম প্রতিরোধে ২০০৮ সালে জাতীয় ই-ক্রাইম ইউনিটও গঠন করা হয়। ভারতে তৈরি হয় ‘তথ্যপ্রযুক্তি আইন ২০০০’।
বাংলাদেশে সাইবার আইন প্রণয়ণে মিশ্র আলোচনা জারি থাকলেও, একটা তথ্য অনেকেরই কাছেই অস্পষ্ট রয়ে গেছে। তা হচ্ছে বাংলাদেশে ২০০৬ সালে তথ্যপ্রযুক্তি ও যোগাযোগ আইন তৈরি করা হয় এবং ২০০৯ সালে এই আইনে কিছু পরিমার্জনা করা হয়। ধরে নেওয়া যাক, এ তথ্যপ্রযুক্তি আইনই আমাদের সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োগ করা হবে।
বিডি২৪লাইভের সর্বশেষ অবস্থান:
হ্যাকিং হবার ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে সাইটটি আবার চালু করা সম্ভব হয়। কিন্তু এর পুরনো কোন তথ্য ফিরে পাওয়া যায়নি। এই জন্য পাঠক সহ সবার কাছে আন্তরিক ভাবে দু:খ প্রকাশ করেছে কতৃপক্ষ।